আজ , বুধবার, ২১ মে ২০২৫

ভয়াল ২৯ এপ্রিল: “প্রলয়ের রাতে হারানো সোনালি স্বপ্ন: মহিউদ্দিন স্মরণে এক শোকগাথা”

লেখক : সাহেদুর রহমান মোরশেদ | প্রকাশ: ২০২৫-০৪-২৯ ০৪:৫৮:০৫

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দিন।

সেই দিন, প্রকৃতির নির্মম রূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল। ভয়াবহ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করেছিল জনপদ। আর আমার ব্যক্তিজীবনে রেখে গিয়েছিল এক অমোচনীয় বেদনার ছাপ, যার ভার আজও আমি ও আমার পরিবার বয়ে চলেছি। সেদিন আমি হারিয়েছিলাম আমার আদরের দ্বিতীয় পুত্র, সাত বছরের ছোট্ট মহিউদ্দিনকে।

ঘটনার দিনটি ছিল একেবারে সাধারণ দিনের মতোই শুরু। বিকেলে আমি আমার পুত্র মহিউদ্দিনকে নিয়ে রাউজানের রমজান আলীর হাটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে ছেলেটি খুব আনন্দে ছিল, ছোট ছোট হাত ধরে আমাকে জড়িয়ে ধরা, পথের ফুল-পাখি দেখানো — যেন কোনো দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
বাড়ি ফিরে আমি আসরের নামাজ আদায় করতে দাঁড়ালাম। মহিউদ্দিনও আমার পাশেই দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লো। মাগরিবের নামাজেও একই দৃশ্য। নামাজের প্রতি তার এই অনুরাগ আমাকে আনন্দিত করেছিল। কে জানতো, এটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ ইবাদত, শেষ নামাজ আদায়!

রাত গড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হতে না হতেই আকাশ যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ল। শুরু হলো প্রবল ঘূর্ণিঝড়। চারপাশে অন্ধকার, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। বাতাসের গর্জন, ছিঁড়ে পড়া গাছের শব্দ, মানুষের আর্তচিৎকার এক ভয়াল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
আমি আমার বাড়ি, রাউজানের মোহাম্মদপুর হাড়ী চান্দ কাজীর বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ি প্রতিবেশীদের সাহায্যে। তখন মহিউদ্দিন ঘরে ঘুমাচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম, ছোট ছেলে ঘরের নিরাপদ কোণে আছে, কিছু হবে না। কিন্তু বিধাতার লীলাখেলা ছিল ভিন্ন।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমার মায়ের—মরহুমা দেলোয়ারা খাতুনের—কান্নার শব্দ শুনে ছুটে ঘরে ফিরলাম।
তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,
“তুমি তো মানুষের সাহায্যে বের হয়েছো, অথচ তোমার নিজের সন্তান ঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে চিরবিদায় নিয়েছে।”

শুনেই আমার মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ছুটে গিয়ে দেখি, আমার প্রাণের টুকরা মহিউদ্দিন ঘরের চাপায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। হাত দিয়ে নাড়া দিলাম, ডাকলাম — কোনো সাড়া নেই। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল।
সেই রাতে, ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস আর সন্তানের মৃতদেহ পাশে নিয়ে আমরা, আমার মা সহ সমগ্র পরিবার, বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। একে একে রাত পেরিয়ে ভোর হলো, কিন্তু আমাদের চোখের পানি শুকালো না।

৩০ এপ্রিল সকালে দেখলাম বাড়ির সামনের হাফেজ বজলুর রহমান সড়ক ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি ও গাছের ধ্বংসাবশেষে বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছিল না। স্বজনেরা, প্রতিবেশীরা হাতে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করলেন যেন মহিউদ্দিনের দাফন সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সকাল ১১টার দিকে, বাড়ির পাশের মুহাম্মদপুর মহিউল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে মহিউদ্দিনের জানাজার নামাজ আদায় করা হয়। এলাকার অনেকেই চোখের জলে জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। জানাজার পর, আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে আমার ছোট্ট মহিউদ্দিনকে শায়িত করা হয়।

সেই দিনের শোক আজও আমার বুকের গভীরে তাজা।
প্রতি বছর ২৯ এপ্রিল এলেই সেই ভয়াবহ রাতের স্মৃতি আমাকে নতুন করে বিধ্বস্ত করে। পরিবার পরিজন সবাই মিলে মহিউদ্দিনের কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলি।

পুত্রশোকের তীব্র দহন সহ্য করতে না পেরে আমি পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিই। রাউজানের মোহাম্মদপুর থেকে চলে আসি ডাবুয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ হিংগলা শান্তিনগর এলাকায়। নতুন করে জীবন শুরু করি, কিন্তু পুরনো সেই বাড়িতে আর কোনোদিন স্থায়ীভাবে ফিরে যাইনি।
সেই বাড়িটি আজও আমার কাছে মহিউদ্দিনের নিঃশ্বাসের শেষ স্মৃতি, তার নিষ্পাপ হাসির চিহ্ন। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে আমি জানি, একদিন সেইসব স্মৃতিই হয়তো আমাকে নিয়ে যাবে মহিউদ্দিনের কাছাকাছি।

৩৫ বছর পেরিয়ে এসেও মহিউদ্দিনের স্মৃতি আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
সে ছিল আমার জীবনের এক আলোকিত অধ্যায়, যা আজো আমাকে অন্ধকার সময়ে আলোকের আশ্বাস দিয়ে যায়।

লেখকঃ সাংবাদিক শফিউল আলম, সাবেক সভাপতি, রাউজান প্রেস ক্লাব

রাউজানবার্তা সম্পাদকের মন্তব্য:

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, তা হাজারো মানুষের জীবনকে এক চিরন্তন শোকের ইতিহাসে পরিণত করে।
সেই প্রলয়ঙ্কর রাতে সাংবাদিক শফিউল আলম তার প্রাণের ধন, ছোট্ট পুত্র মহিউদ্দিনকে হারান।
এই স্মৃতিচারণে তিনি কেবল এক সন্তানের করুণ মৃত্যু নয়, বরং এক পিতা ও পরিবারের ভাঙচুর হয়ে যাওয়া পৃথিবীর যন্ত্রণাময় প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন।
সত্যিই, এমন হৃদয়বিদারক স্মৃতি পাঠক হৃদয়েও গভীর দাগ কাটবে।
শুধু ব্যক্তিগত শোক নয়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের মতো দুর্যোগগুলো কীভাবে মানবজীবনকে তছনছ করে দেয়, তার জীবন্ত দলিল হয়ে থাকবে এই লেখা।